Thursday, July 26, 2018

পারলে শেয়ার করুনঃ হয়তো শারমিনদের মত অসহায় মেয়েদের পাশে কেউ না কেউ এসে দাড়াতে পারেঃ

পারলে শেয়ার করুনঃ
হয়তো শারমিনদের মত অসহায় মেয়েদের পাশের কেউ না কেউ এসে দাড়াতে পারেঃ
চোখের মনিটা তার কালো হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু কালো নয়, হয়ে গেলো সাদা। নাম না বলে তার উদ্দেশ্যে কিছু বললে সেটা হয়তো সে বুঝতে পারবে না। যতক্ষণ না, তাকে একটু স্পর্শ করে ইঙ্গিত করা হবে যে তাকে কিছু বলা হচ্ছে। সে হয়তো আপনার দিকে তাকাবে। সেই তাকানোতে দৃষ্টি নেই। সেখানে শুধুই শূন্যতা। কারণ, তার চোখে যে আলো নেই! নিষ্ঠুর এই পৃথিবী তার চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে ছয় বছর বয়সে। এখন সে দৃষ্টিহীন। সমাজ যাদের নাম দিয়েছে ‘অন্ধ’।

যার কথা বলা হলো এতক্ষণ, নাম তার শারমিন আক্তার। নিয়তি যদি শুধুমাত্র তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হতো, তাতেও অনুযোগ করার কোনো কারণ থাকতো না। কিন্তু তার দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার আগে নিয়তি কেড়ে নিয়েছে তার বাবাকে। মায়ের গর্ভে যখন আট মাস, তখনই না ফেরার দেশে চলে যায় শারমিনের বাবা। জন্মের এক বছরের মধ্যে হারালো মা’কেও। ওই এতটুকুন বয়সে আশ্রয় মিলেছিল বাগেরহাটে নানির কাছে। মাত্র এক বছর বয়সে মা-বাবা দু’জনকেই যে হারিয়ে ফেলে, তার চেয়ে অসহায় আর কে আছে পৃথিবীতে?

শারমিনের পৃথিবীটা তাই জন্মের পর থেকেই অন্ধকার! তার চোখের আলো থেকেও যেন কোনো লাভ ছিল না। তবুও, যে চোখ তাকে পথ চলতে আলো বিলাতো, সেই চোখের আলোও হারিয়ে ফেললো মাত্র ৬ বছর বয়সে। চোখের মনি কালো থেকে সাদা হতে লাগলো। দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো শারমিন আক্তারের।

মামা-বাবা থাকলে হয়তো শারমিনকে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো। কিন্তু যে কি-না পৃথিবীর চেয়েও ভারি কষ্ট বুকে নিয়ে জন্ম নেয়, তার জন্য আর ভালো কি অপেক্ষা করতে পারে? শারমিনের ভাগ্যেও জুটলো না কোনো চিকিৎসা। ৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই এক সময় সে সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। হয়ে যায় পুরোপুরি অন্ধ।

একবার শুধু নিজেকে ছয় বছর বয়সী এই মেয়েটার জায়গায় কল্পনা করে দেখুন! কল্পনা করুন, আপনার বাবা-মা নেই, এরপর আপনি দৃষ্টি শক্তিও হারিয়ে ফেললেন। এই দুনিয়ায় চারপাশে কেউ নেই, কেমন অনুভূতি হবে আপনার? সত্যিকারার্থেই পৃথিবীতে শারমিন আক্তারের চেয়ে অসহায় আর কেউ ছিল না তখন।

অন্ধ অবস্থায় নানির কাছে কাটলো আরও প্রায় পাঁচ বছর; কিন্তু এমন এক প্রতিবন্ধী ছোট্ট মেয়েকে মায়া-মমতা আর আদর ভালোবাসা দিয়ে কতদিন কে আগলে রাখবে? এখনকার সমাজ যেখানে একজন সুস্থ-সবল মানুষকেও আশ্রয় দিতে অপারগ, সেখানে ৯-১০ বছর বয়সী একজন অন্ধের দায়িত্বভার টানবে কে? টানলো না শারমিনের নানিও। তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাকে রাস্তায় ফেলে চলে যাওয়ার। কী নিষ্ঠুর চিন্তা, কী নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত! মেয়েটি তার কিছুই জানতে পারলো না।

১১ বছর বয়স তখন তার। হঠাৎ একদিন তার নানি তাকে বললো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। নিয়ে আসলো ঢাকায়। কোনো এক রাস্তায় তাকে দাঁড় করিয়ে নানি বললো, তুমি এখানে দাঁড়াও আমরা আসতেছি। সেই যে গেলো আর ফিরলো না। শারমিন সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকলো বিকেল পর্যন্ত। অপেক্ষা আপনজনের। তারা আসবে, তাকে নিয়ে যাবে; কিন্তু কেউ আর ফিরলো না। বাবা-মা দু’জনকে হারানোর পর যখন চোখের আলোটাও হারিয়ে ফেললো, তখন নানিই ছিল তার সব কিছু, তার শেষ সম্বল। শেষ পর্যন্ত সেই সম্বলটাও হারিয়ে ফেললো শারমিন। অথৈ সাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজের যেন বেঁচে যাওয়া কোনো যাত্রী। যার চারপাশে, অথৈ পানি। আপন বলতে কেউ নেই।
‘প্রচুর মানুষ আমাকে দেখছিল। এখন যেমন আমাকে দেখলেই অন্ধ মনে হয়, তখন ততটা মনে হতো না। রাস্তার এক জায়গায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকার কারণে মানুষ বুঝতে পারলো, কোনো একটা সমস্যা। তখন অনেকেই এলো। ভিড় জমালো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি কেন?’- এভাবেই ওই সময়টার অনুভূতি ব্যক্ত করলো শারমিন।

শারমিন এবার লোকদের জানালো তার করুন কাহিনি। মা-বাবা নেই, দৃষ্টি শক্তি নেই। নানিও এখানে রেখে আসছে বলে আর আসেনি। শারমিনের দায়িত্ব তখন এক ব্যক্তি নিতে চাইলো। কিন্তু সে ভরসা পেলো না। তার সাথেও গেলো না। যদিও খানিক পর এক মহিলা তাকে বললো, তার কোনো বাচ্চা নেই। নিজের মেয়ের মতো করেই রাখবে। সেই মহিলা শারমিনকে নিয়ে গেলো তার বাসায়। যদিও পরে মেয়েটি বুঝতে পারে, তাকে নিয়ে আসা হয়েছে একটি বস্তি এলাকায়। যেভাবে রাখবে বলে এনেছিল, সেভাবে রাখলো না।

সেখানেই মোহাম্মদপুর আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষকের নজরে পড়েন শারমিন এবং তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন নিজের বাসায়। ওই শিক্ষকের বাসাতেই ভালোভাবে কাটছিল শারমিনের। তবে তার তো পড়া-লেখা প্রয়োজন। চোখের আলো নেই। তাতে কি! শিক্ষার আলোয় শিক্ষিত হতে পারলে মনের আলো বেড়ে যাবে। সেই মনের আলোয় হয়তো নিজের পৃথিবীটাও আলোকিত করে তুলতে পারবে শারমিন।

এ জন্যই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরে একটি অন্ধ স্কুলে। কিন্তু সেখানে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। পরে নিয়ে আসা হলো, আদাবরে ইমাম ফাউন্ডেশন নামে অন্ধ মেয়েদের জন্য পরিচালিত একটি আবাসিক স্কুলে। সেখানেই আরও ২৪-২৫ জন অন্ধ মেয়ের সঙ্গী হলো শারমিন। এখান থেকেই নিজের জীবনের আলো খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছে চির অসহায় মেয়েটি। এখানে পড়ছে সাধারণ শিক্ষায়, পঞ্চম শ্রেণিতে।

যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারমিনসহ ২৫-২৬টি অন্ধ মেয়ে আবাসিক হিসেবে থেকে নিজেদের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর ডান পাশে মোড় ঘুরতেই চোখে পড়বে পারস্য কবি ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত সেই বাণী, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়...।’ কিন্তু আমরা চক্ষুষ্মানরা যে সব বই পড়ি, সেগুলো পড়ার কোনো সুযোগ নেই শারমিনদের। অন্ধদের জন্য তৈরি ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করে তারা জাগিয়ে তুলতে চায় মনের আলো। সেই আলোয় আলোকিত করতে চায় পৃথিবীকে।

পারবে কি শারমিন আক্তার? যে ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে এখন জীবনটা একটা স্বপ্নময় বাস্তবতার দিকে এগিয়ে চলছে, সেই ফাউন্ডেশনও চলছে মানুষের অনুদানে। যা অকেটাই অপ্রতুল। দৃষ্টিশক্তির প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ হারিয়ে ফেলা এক হৃদয়বান ব্যক্তি, সাইয়েদ ইমাম হাছান ইমামের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ইমাম ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে অন্ধ ২৬টি মেয়ে।

তাদেরকে আলো দেখানোর নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি। পরিচালক সাইয়েদ ইমাম হাছান ইমাম এই প্রতিষ্ঠানের অন্ধ মেয়েগুলোর বাবা, তার স্ত্রী মেয়েগুলোর মা। এমন বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে থেকে শারমিনরা হয়তো অনেকদুর এগিয়ে যাবে। তবে, একই সঙ্গে সরকার এবং সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিদেরও তাদের এই অসাধারণ উদ্যোগের সহায়তায় এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাহলে হয়তো বা শারমনিদের মতো আরও অনেক অসহায় অন্ধ মেয়ে খুঁজে পাবে তাদের জীবনের আলো।

No comments:

Post a Comment